ডেঙ্গু জ্বর হলে করণীয় কি? ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ ও চিকিৎসা ২০২১-Dengue fever

 

ডেঙ্গু জ্বর হলে করণীয় কি?  ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ ও চিকিৎসা ২০২১-Dengue fever

বর্তমান সময়ের আতংকের আরেক নাম ডেঙ্গু জ্বর।
এই করোনাকালিন সময়ে আমরা হালকা জ্বর হলেই টেনশনে পরে যায় যে করোনা হলো কিনা। কিন্তু জ্বর হলেই কি করোনা হতে পারে?  এমনটি ধারণা করাও ভুল।জ্বর শুধু করোনার জন্য না ডেঙ্গুর জন্য ও হতে পারে। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রতি বছর ঠিক এই সময়টাতেই ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়ে যায়। এমনকি অনেক মানুষ মারা ও যাচ্ছে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে। তাই ডেঙ্গু থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে আমাদের সতর্ক হয়ে থাকতে হবে।
তাই আজকে আমরা ডেঙ্গু জ্বর সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবো।

ডেঙ্গু জ্বর কি? What is dengue fever? 

ডেঙ্গু হল একটা মশা বাহিত রোগ। এডিস ইজিপ্টাই নামক মশার কামড়ে ডেঙ্গু জ্বর হয়ে থাকে ।এই এডিস মশা কোন ব্যক্তিকে কামড়ালে, সেই ব্যক্তি ৪ থেকে ৬ দিনের মধ্যে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়। আবার এই আক্রান্ত ব্যক্তিকে কোন সাধারণ মশা অর্থাৎ জীবাণুবিহীন মশা কামড়ালে, সেই মশাটিও এডিস মশায় পরিনত হয় অর্থাৎ ডেঙ্গু জ্বরের জীবাণুবাহী মশায় পরিণত হয়।তারপর সেই মশা আরেকজনকে কামড়ালে সে ও আক্রান্ত হয়।  এভাবে একজন থেকে অন্যজন মশার কামড়ের মাধ্যমে ডেঙ্গু চারদিকে ছড়িয়ে থাকে।

আরো পড়ুনঃ ছেলেদের মুখে ছোট ছোট ব্রণ ও কালো দাগ দূর করার উপায়

ডেঙ্গু জ্বরের উৎপত্তি

এডিস মশা 'ভদ্র মশা' হিসেবে পরিচিত কেননা তাদের জন্ম হয় স্বচ্ছ পানিতে এবং তারা বাস করে সুন্দর-সুন্দর ঘরবাড়িতে।
এডিস মশা সাধারণত ডিম পাড়ে স্বচ্ছ ও পরিস্কার পানিতে।সাধারণত দেখা যায় বৃষ্টির স্বচ্ছ পানি কোথাও জমে থাকলে সেই জায়গা থেকে মশার উৎপত্তি হয়। 

 
সাধারণ পানি হোক বা বৃষ্টির পানি, এ পানি যে কোন জায়গায় জমতে পারে। বাড়ির ছাদে কিংবা বারান্দার ফুলের টবে,বা বিভিন্ন নির্মাণাধীন ভবনের বিভিন্ন পয়েন্টে, বাড়ির আশেপাশে বা  রাস্তার পাশে পড়ে থাকা টায়ার কিংবা অন্যান্য পাত্রে জমে থাকা পানিতে এডিস মশা বংশবিস্তার করে। তাই কোথাও যাতে পানি তিন থেকে পাঁচদিনের বেশি জমা না থাকে সেই দিকে খেয়াল রাখতে হবে।


ডেঙ্গু জ্বরে কখন আক্রান্ত হয়।

প্রতি বছর  মে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত, বিশেষ করে গরম এবং বর্ষার সময়টাতেই ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ বেশি থাকে, কেননা বৃষ্টির স্বচ্ছ পানিতে ডেঙ্গু বিস্তার করে বেশি। শীতকালে এই জ্বর  দেখা যায়না তবে শীতে লার্ভা অবস্থায় ডেঙ্গু মশা অনেক দিন বেঁচে থাকতে পারে। বর্ষার শুরুতেই বৃষ্টির পানিতে সেগুলো থেকে নতুন করে ডেঙ্গু ভাইরাস বাহিত মশা বিস্তার লাভ করে।

আরো পড়ুনঃ নাকের পলিপাস হওয়ার কারণ ও আধুনিক চিকিৎসা।

ডেঙ্গু জ্বর কাদের বেশি হয়

সাধারণত শহর অঞ্চলে এই মশার পাদুর্ভাব বেশি থাকে , বড় বড় দালান কোঠায়, বারান্দায় রাখা টবে বা বাসার ছাদে জমে থাকা পনিতে এই মশার বিস্তার বেশি হয়ে থাকে। তাই শহরাঞ্চলের মানুষ ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয় বেশি। এবং যারা গ্রামে বা বস্তিতে বসবাস করে তারা কম আক্রান্ত হয়।


এডিস মশা কখন কামড়ায়

এডিস মশার কামড়ে ডেঙ্গু জ্বর হয়ে থাকে। এই মশা সাধারণত রাতের বেলা বা  অন্ধকারে কামড়ায় না। তারা দিনের বেলায় সকালের দিকে এবং সন্ধ্যার কিছু আগে এডিস মশা তৎপর হয়ে উঠে।ওই সময়ে তারা কামড়ায় বেশি। তাই ওই সময়ে আমাদের বেশি সতর্ক থাকতে হবে।

ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণসমূহ :

ডেঙ্গু জ্বরের বিশেষ কতগুলো লক্ষণ রয়েছে।
ডেঙ্গু জ্বর প্রধানত দুই ধরনের হয়ে থাকে,

  • ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু ফিভার।
  • ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার।


ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ

  • সাধারণত তীব্র জ্বর থাকে।  জ্বর ১০৫ ফারেনহাইট পর্যন্ত হয়ে থাকে।
  • সারা শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা থাকা।
  • শরীরে বিভিন্ন অংশে ব্যাথা হওয়া  বিশেষ করে হাড়, কোমড়, পিঠসহ অস্থি সন্ধি এবং মাংসপেশীতে প্রচন্ড ব্যথা হওয়া।
  • মাথাব্যথা ও চোখের পিছনে ব্যথা হওয়া।
  • অনেক সময় ব্যথা এত তীব্র হয় যে মনে হয় যেন  হাড় ভেঙ্গে যাবে। তাই এই জ্বরের আরেক নাম “ব্রেক বোন ফিভার”।
  • জ্বর হওয়ার ৩ বা ৪ দিনের সময় সারা শরীরে লালচে গুটি গুটি দানার মত দেখা যায়, যাকে বলা হয় স্কিন র‌্যাশ, দেখতে অনেকটা এলার্জি বা ঘামাচির মতো।
  •    বমি বমি ভাব এবং বমি হওয়া।
  • অতিরিক্ত ক্লান্তিবোধ হওয়া।
  •   রুচি কমে যাওয়া।


ডেঙ্গু হেমোরেজিক জ্বরের লক্ষণ :

এই অবস্থাটাই সবচেয়ে জটিল ও মারাত্মক হয়ে থাকে । এই জ্বরে ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ ও উপসর্গের পাশাপাশি আরো বিভিন্ন  সমস্যা দেখা যায় তা হল-

  • শরীরের বিভিন্ন অংশ থেকে রক্ত পড়া শুরু হওয়া।
  • শরীরের বিভিন্ন অংশ দিয়ে রক্তক্ষরণ অর্থাৎ চামড়ার নিচে, নাক ও মুখ দিয়ে, মাড়ি ও দাঁত হতে, কফের সঙ্গে রক্ত বের হওয়া, রক্তবমি, পায়খানার সাথে তাজা রক্ত বা কালো পায়খানা হওয়া।
  • চোখের মধ্যে এবং চোখের বাহিরে লালচে হওয়া বা রক্ত জমে যাওয়া।
  • মহিলাদের বেলায় অসময়ে ঋতুস্রাব অথবা রক্তক্ষরণ শুরু হলে অনেকদিন পর্যন্ত রক্ত পড়তে থাকা ইত্যাদি।
  • শরিরের বিভিন্ন অংশে পানি আসা। যেমন,  বুকে পানি, পেটে পানি পায়ে পানি  আসা।
  • লিভার ২ সেন্টিমিটারের চেয়েও বড় হয়ে যায় এবং লিভার বা কিডনিতে সমস্যা দেখা দেয়।


ডেঙ্গু শক সিনড্রোম :

ডেঙ্গু জ্বরের সবথেকে ভয়াবহ ও মারাত্মক রূপ হল ডেঙ্গু শক সিনড্রোম। ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারের সাথে সার্কুলেটরী ফেইলিউর হয়ে ডেঙ্গু শক সিনড্রোম দেখা দেয়।
এর লক্ষণ হল-

  • হঠাৎ রক্তচাপ কমে যাওয়া।
  • নাড়ীর স্পন্দন অত্যন্ত ক্ষীণ ও দ্রুত হয়।
  • শরীরের বিভিন্ন অংশ এবং হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যায়।
  • প্রস্রাব কমে যায়।
  • হঠাৎ করে রোগী অজ্ঞান হয়ে যায়। এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হওয়ার সম্ভবনা থাকে।


আরো পড়ুনঃ মূখের দূর্গন্ধ দূর করার সেরা ১২ টি কার্যকরী প্রাকৃতিক উপাদান

কখন ডাক্তার দেখাবেন :

ডেঙ্গু জ্বরের সাধারনত  নির্দিষ্ট করে  কোনো চিকিৎসা নেই। তবে এই জ্বর সাধারণত নিজে নিজেই ভালো হয়ে যায়। তাই উপসর্গ অনুযায়ী সাধারণ চিকিৎসাই যথেষ্ট। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে যদি রোগীর অবস্থা মারাত্মক হয় তাহলে সাথে সাথে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। এবং কিছু কিছু লক্ষণ দেখা দিলে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা নেওয়া ভাল।
যেমন -

  • হঠাৎ শরীরের কোন অংশ থেকে রক্তপাত দেখা দিলে।
  • হঠাৎ শরীরের প্লাটিলেটের মাত্রা কমে গেলে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
  • শ্বাসকষ্ট হলে বা পেট ফুলে গেলে এবং পানি আসলে।
  • প্রস্রাবের পরিমাণ কমে গেলে বা প্রস্রাব না হলে।
  • ডেঙ্গু জ্বরে যদি জন্ডিস দেখা দেয়।
  • শরির অতিরিক্ত ক্লান্তি বা দুর্বলতা দেখা দিলে।
  • প্রচণ্ড পেটে ব্যথা বা বমি হলে।


ডেঙ্গু জ্বরের চিকিৎসা 

ডেঙ্গু জ্বরের সাধারনত কোন চিকিৎসা নেই,  আক্রান্ত  রোগী ৫থেকে ১০ দিনের মধ্যে নিজে নিজেই ভালো হয়ে যায়।
তবে রুগীর অবস্থা মারাত্মক হলে দ্রুত হসপিটালে নিয়ে যেতে হবে এবং ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা দিতে হবে। সাধারণত লক্ষণ অনুযায়ী চিকিৎসা দেওয়া হয়।
এই রোগের জন্য  বাড়িতে থেকেই চিকিৎসা নিতে পারেন। এবং এই ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হলে যা করণীয়।

  • রুগী সম্পূর্ণ ভালো না হওয়া পর্যন্ত পূর্ণ বিশ্রামে থাকতে হবে।
  • সবসময় পানি, শরবত, ডাবের পানি ও অন্যান্য তরল জাতীয় খাবার গ্রহণ করতে হবে যাতে সমস্যা বৃদ্ধি না পায়।
  • যদি রুগী একদম খেতে না পারে দরকার হলে শিরাপথে স্যালাইন দেওয়া যেতে পারে।
  • জ্বর কমানোর জন্য অতিরিক্ত কোন ওষুধ খাওয়ার দরকার নেই  শুধুমাত্র  প্যারাসিটামল-জাতীয় ব্যথার ওষুধই যথেষ্ট। এসপিরিন বা ডাইক্লোফেনাক-জাতীয় ব্যথার ওষুধ ভুলে ও  খাওয়া যাবে না। এতে রক্তক্ষরণের মারাত্মক ঝুঁকি বাড়বে।
  • জ্বর কমানোর জন্য একটু পর পর ভেজা কাপড় দিয়ে গা মোছাতে হবে।


ডেঙ্গু রোগের প্রতিকার বা আমাদের করণীয়।

যেহেতু ডেঙ্গু একটি মশা বাহিত রোগ তাই মশার কামড় থেকে নিজেকে নিরাপদ রাখতে পারলে ডেঙ্গু রোগের প্রকোপ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। এজন্য আমাদের যা করতে হবে -

  • সবসময় বাড়ির আশে পাশে সকল জায়গা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখুন। 
  • বাড়ির আশে পাশে,  ছাদে, বা বারান্দায় বা  টবে কোথায় যেন পানি ৩-৫ দিনের বেশি জমে না থাকে সেদিকে লক্ষ রাখুন। 
  • দিনে বা রাতে  ঘুমানোর সময় অবশ্যই মশারী টাঙিয়ে ঘুমাতে হবে। 
  • ডেঙ্গুর প্রকোপের সময়, দিনের বেলায় ঘুমানোর অভ্যাস পরিত্যাগ করুন। 
  • মশা নিধনের স্প্রে, কয়েল, ম্যাট ব্যবহারের সঙ্গে মশারি ও ব্যবহর করুন।
  • কেউ ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে তাকে অবশ্যই সব সময় মশারির মধ্যে রাখতে হবে, যাতে করে কোনো মশা কামড়াতে না পারে।


শেষ কথা

বর্তমানে আমাদের জ্বর হলে অবহেলা না করে ডাক্তার দেখানো উচিৎ। কেননা আমাদের দেশের করোনা ভাইরাসের লক্ষণ ও জ্বর তাই জ্বর হলে আমরা বুঝতে পারবোনা এটা কি সাধারণ জ্বর নাকি করোনার লক্ষণ নাকি ডেঙ্গু জ্বর।
তাই আমাদের জ্বর হলে অবহেলা না করে ডাক্তার দেখানো উচিত। ধন্যবাদ




Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url