রোজা ভঙ্গের কারণ ও রোজার মাকরূহ সমূহ

রোজা ভঙ্গের কারণ ও রোজার মাকরূহ: রমজান হল ইবাদাতের মাস। এই মাসে যত বেশি ইবাদাত করা যায় ততই ভাল। কেননা এই মাসের ইবাদাত আল্লাহর নিকট খুবই প্রিয় যার ফলে দেখা যায় এই মাসের ইবাদাতের সওয়াব অন্যান্য মাসের ইবাদতের চেয়ে ৭০ গুণ বেশি সওযাব পাওয়া যায়।এই মাসে যত বেশি ইবাদত করা যায় তত ভাল। হাদিসে রয়েছে রোজার পুরস্কার আল্লাহ তায়ালা নিজ হাতে বান্দাের দিবেন। 

রোজা ভঙ্গের কারণ ও রোজার মাকরূহ সমূহ

পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা রোজা সম্পর্কে ইরশাদ করেন, হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর, যেন তোমরা মুত্তাকি হতে পার। (সুরা বাকারা : আয়াত ১৮৩)। এক হাদিসে প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে ও সওয়াবের নিয়তে রমজান মাসের রোজা রাখবে তার পূর্বের সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে। 

রোজা ভঙ্গের কারণ কি কি ও রোজার মাকরূহ সমূহ 

এই মাসের প্রধান ইবাদত হচ্ছে রোজা। রোজা আমাদের সঠিক ভাবে রাখতে হবে। তাই আমাদের জানতে হবে কি কারণে রোজা ভেঙে যায় এবং কি কি কারণে রোজা মাকরূহ হয়। তাহলে এই বিষয় গুলো থেকে বেঁচে থাকতে পারবো। আমাদের রোজা ও পরিপূর্ণ হবে। 

তাই চলুন জেনে নেই যেসব কারণে রোজা ভঙ্গের কারণ ও রোজা মাকরূহ হওয়ার কারণ সমূহ। 

রোজা ভঙ্গের কারণ সমুহ:

১. কেউ যদি ইচ্ছাকৃতভাবে কোন কিছু পানাহার করলে।

২. ইচ্ছাকৃত ভাবে স্ত্রী সহবাস করলে।  অথবা ভুলে সহবাস করে ফেলার পর রোজা ভেঙে গেছে মনে করে আবার সহবাস করলে। 

৩. রোজা স্বরণ থাকা অবস্থায় কুলি করার সময় কন্ঠণালীতে পানি চলে গেলে (তবে যদি ঐ সময় রোজার কথা স্মরণ না থাকে তাহরে রোজা ভাঙ্গবে না)।

৪. ইচ্ছকৃত মুখভরে বমি করলে।

৫. নস্য গ্রহণ করা, কোন ঔষধ বা তৈল নাকে ও কানে প্রবেশ করালে।

৬. জোর করে কেউ কোন কিছু খাওয়ালে বা রোজা ভাঙ্গালে ।

৭. ইনজেকশান বা স্যালাইরনর মাধ্যমে পেটে ঔষধ পৌছালে।

৮. কংকর পাথর কোন কাগজ বা ফলের বিচি গিলে ফেললে।

৯. সূর্যাস্ত হয়েছে বা ইফতারের সময় হয়েছে মনে করে ইফতার করার পর দেখা গেল সুর্যাস্ত হয়নি বা িফতারের সময় হয়নি তাহলে রোজা ভেঙে যাবে।

১০. পুরা রমজান মাসে একবার ও রোজার নিয়ত না করলে।

১১. দাঁতে আটকে থাকা ছোলা পরিমান কোন খাদ্য-দ্রব্য গিলে ফেললে।

১২. ধূমপান করলে এবং ইচ্ছাকৃত লোবান বা আগরবাতি জ্বালিয়ে তার ধোঁয়া গ্রহন করলে।

১৩. অনিচ্ছাকৃত বমি হওয়ার পর তা গিলে ফেললে। 

১৪. রাত্রি আছে বা সেহরির সময় আছে মনে করে সোবহে সাদিকের পর কোন কিছু পানাহার করলে।

১৫. মুখে পান রেখে ঘুমিয়ে গেলে এবং সুবহে সাদিকের পর নিদ্রা হতে জাগরিত হওয়া ( তবে এই অবস্থায় শুধু কাজা ওয়াজিব হবে।)

১৬. হস্তমৈথুন করলে। 

আরো পড়ুনঃ রোজার নিয়ত ও ইফতারের দোয়া বাংলা উচ্চারণ ও অর্থসহ 

রোজার মাকরূহ সমূহ:

মাকরূহ বলতে অপছন্দনীয় কাজ। রোজা মাকরূহ বলতে এমন কিছু কাজ করা যা রোজা ভাঙ্গবেনা তবে সেটা মাকরূহ বা নিন্দনীয় হবে। রোজা রাখা অবস্থায় ও আমাদের এমন কাজ থেকে ও বিরত থাকতে হবে। নিচে এমন কয়েকটি মাকরূহ কাজ উল্লেখ করা হল। 

১. দিনে সঠিকভাবে রোজা রাকার পর সন্ধ্যায় ইফতারির সময় আপনি যদি এমন কোনও খাবার গ্রহণ করেন যেটি খাওয়া ইসলামের দৃষ্টিতে হারাম, তাহলে আপনার দিনের রোজা মাকরুহ হবে।

২. কোনও কারণ ছাড়াই কোন কিছু চিবুতে থাকে তাহলে  রোজা মাকরুহ হবে।

৩. খাবার ছাড়া ও কোনও কিছু মুখে রেখে দিলে, তা না  খেলে ও তাতেও রোজা মাকরুহ হবে।

৪. রোজায় গড়গড়া কুলি করা বা নাকের ভেতর পানি টেনে নেওয়ায় রোজা মাকরুহ হয়। আর এমন করা অবস্থায় পেটে পানি চলে গেলে রোজা ভেঙ্গে যায়।

৫. মুখের লালা স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় পেটে গেলে বা গিলে ফেললে ক্ষতি নেই, তবে ইচ্ছাকৃত দীর্ঘ সময় মুখে থুথু ধরে রেখে বা জমা করে  পরে গিলে ফেললে এতে রোজা মাকরুহ হবে।

৬. রমজানের সারাটি দিন শরীর নাপাক রাখলেও রোজা মাকরুহ হবে। এবং এটা জগন্যতম অপরাধ ও। 

৭. কোনও বিষয়ে অতিরিক্ত অস্থির হয়ে উঠলে কিংবা কাতরতা দেখালে রোজা মাকরুহ হয়ে যেতে পারে। কোনও কোনও ব্যাখ্যায় এটা উল্লেখ করা হয়েছে। 

৮. যে কোন পাউডার, পেস্ট ও মাজন দিয়ে দাঁত মাজলে রোজা মাকরুহ হয়ে যায়।

৯. মুখে গুল ব্যবহার করা মাকরুহ।আর যদি থুথুর সঙ্গে গুল গলার ভেতর চলে যায় তাহলে রোজা ভেঙ্গে যাবে।

১০. রোজা রেখে কারো গিবত করলে বা পরনিন্দা করলে কাউকে গালি দিলো রোজা মাকরুহ হয়।

১১. মিথ্যা কথা বলা মহাপাপ সবাই জানি। কিন্তু রোজা রেখে এ কাজটি করলে রোজা মাকরুহ হবে।

১২. রোজা রেখে কারো সাথে ঝগড়া-বিবাদ বা গালাগালি  করলে রোজা মাকরুহ হবে।

১৪. যৌন উত্তেজনা বাড়ে এমন কিছু দেখা বা শোনা থেকে বিরত থাকতে হবে। এতেও রোজা মাকরুহ হবে।

১৫. নাচ, গান, সিনেমা দেখা বা এমন কিছু দেখা যা উচিত নয় এবং তাতে মজে থাকলে রোজা মাকরুহ হয়।

১৬. রান্নার সময় রোজাদার কোনও তরকারির স্বাদ নিলে, লবন চেখে দেখলে, ঝাল পরীক্ষা করলে যে ঠিকঠাক আছে কিনা তাহলে তা মাকরুহ হয়। তবে বিশেষ প্রয়োজনে সেটা যদি করতেই হয়, তাহলে বৈধ হিসেবেই ধরা হয়। 

যেসব কারণে রোজা না রাখলে ক্ষতি নেই তবে কাযা আদায় করতে হবে:

★কোনো অসুস্থতার কারণে রোযা রাখার শক্তি না থাকলে অথবা রোজা থাকলে অসুখ বৃদ্ধির ভয় হলে রোজা ভঙ্গ করা বৈধ হবে। তবে পরে সুস্থ হলে তা কাযা করতে হবে।

★গর্ভবতী নারী রোজা রাখলে যদি  সন্তান বা নিজের প্রাণ নাশের আশঙ্কা হয় তাহলে রোজা ভঙ্গ করা বৈধ তবে পরবর্তীতে কাযা করে দিতে হবে।

★যেসব স্ত্রী লোক নিজের বা অপরের সন্তানকে দুধ পান করান কিন্তু যদি রোজা রাখার ফলে যদি দুধ না আসে বা বাচ্চার দুধের সংশয় দেখা দেয় তবে রোজা না রাখার  অনুমতি আছে, কিন্তু পরে কাযা আদায় করতে হবে।

★ শরিয়তসম্মত মুসাফির অবস্থায় রোযা না রাখার অনুমতি আছে। তবে যদি কষ্ট না হয় তাহল রাখাই উত্তম।

★ কেউ হত্যার হুমকি দিলে এমতাবস্থায় রোযা ভঙ্গের অনুমতি আছে। তব  পরে তা এর কাযা করতে হবে।

★ কোনো রোগীর ক্ষুধা বা পিপাসা এতোটাই বেড়ে গেছে  এবং কোনো দ্বীনদার মুসলিম চিকিৎসকের মতে যদি এখন রোজা ভঙ্গ না করা হয় তাহলে তার মৃত্যুর আশঙ্কা আছে। তবে রোযা ভঙ্গ করা ওয়াজিব। পরে তা কাযা করতে হবে।

★ নারীদের মাসিকের সময় এবং বাচ্চা প্রসবের পর ৪০ দিন নেফাসগ্রস্ত অবস্থায় নারীদের জন্য রোজা রাখা জায়েজ নয়। পরবর্তীতে তা কাযা করতে হবে।

রোজার কাযা আদায় করার নিয়ম কি? 

যদি রমজান মাসের ফরজ রোজা শরিয়ত অনুমোদিত কোন কারণে রোজা ভাঙ্গতে হয় তাহলে একটি রোজার পরিবর্তে একটি রোজা কাযা আদায় করলেই হবে। যদি একাধিক রোজা কাযা হয় তাহলে পরবর্তীতে যে কোন সময় কাযা আদায় করে নিবে। লাগাতার রাখার প্রয়োজন নেই ভেঙ্গে ভেঙ্গে রাখলে ও হয়ে যাবে। 

আরো পড়ুনঃ তারাবির নামাজের নিয়ত,  দোয়া ও মোনাজাত অর্থ সহ 

ইচ্ছাকৃত রোজা ভঙ্গের কাফফারা কি?

কাফফারা শব্দটি আরবি । এর শাব্দিক অর্থ জরিমানা, পরিপূরক বা আবরণ। রোজা ভঙ্গের কাফফারা বলতে রমজান মাসের ফরজ রোজা শরিয়ত অনুমোদিত কোন কারণ ছাড়া ইচ্ছাকৃত রোজা ভেঙে ফেললে পরবর্তীতে ওই ফরজের দায় থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য একটি রোজার পরিবর্তে ষাটটি রোজা রাখা বোঝায়। 

তবে কাফফারা ৩ ভাবে আদায় করা যায়। 

১। গোলাম আজাদ করার মাধ্যমে। অর্থাৎ ইচ্ছাকৃত কোন একটি রোজা ভাঙ্গলে তার পরিবর্তে একজন গোলাম আজাদ করা। 

২। ৬০ জন মিসকিস কে খাওয়ানো। অর্থাৎ গোলাম আজাদ  সম্ভব না হলে ৬০ জন মিসকিন কে পেট ভরে খাওয়াতে হবে। 

৩। যদি তা ও সম্ভব না হয় তাহলে ইচ্ছাকৃত একটি রোজা ভাঙ্গার কারণে লাগাতার ৬০ টি রোজা কাফফারা হিসাবে আদায় করতে হবে। 

কেউ যদি শরিয়ত অনুমোদিত তোন কারণ ছাড়াই কাফফারার রোজা ভেঙে ফেলে তাহলে তাকে আবার প্রথম থেকে ৬০ টি রোজা রাখতে হবে। ধরেন কেউ যদি ৫০ টা রোজা রাখার পর একটা ভেঙে ফেলে তাহলে আগের ৫০ টি বাতিল হয়ে যাবে এবং পূনরায় ৬০ টি একনাগারে রাখতে হবে। তবে মেয়েদের মাসিক হলে বা শরিয়ত অনুমোদিত কোন কারণ থাকলে আগের গুলো বাতিল হবে না। এরপর থেকে আদায় করলেই হয়ে যাবে। 

রোজা সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন ও তার উত্তর

প্রশ্নঃ রোজা রেখে করোনার টিকা নেওয়া যাবে কি 

উত্তরঃ রোজা রেখে করোনার টিকা দেওয়া যাবে এতে কোন সমস্যা নেই। কারণ টিকার পরিমান খুবই অল্প আর এটা রক্তে মিশে যায় কোনভাবেই পাকস্থলীতে পৌঁছায় না। এবং এতে এমন উপাদান নেই যা খাবারের বিকল্প হিসেবে কাজ করে। তাই রোজা রোখে টিকা দেয়া জায়েজ রয়েছে। 

প্রশ্নঃ সেহরি না খেলে কি রোজা হবে? 

উত্তরঃ অবশ্যই হবে। সেহরি হল আলাদা বিষয়। সেহরি খাওয়া কোন বাধ্যবাধকতা নেই। আপনি ঘুম ভেঙে দেখলেন সেহরির সময় শেষ তাহলে শুধু রোজার নিয়ত করে নিবেন এতে রোজা হয়ে যাবে। তবে সেহরি খাওয়া হল উত্তম। 

প্রশ্নঃ রোজা রেখে কি দাত ব্রাশ করা যাবে? 

উত্তরঃ রোজা রেখে দাত ব্রাশ করলে রোজা মাকরূহ হবে আর যদি ব্রাশ করার সময় কোন কিছু পেটে চলে যায় তাহলে রোজা ভেঙ্গে যাবে। তাই উত্তম হল মেসওয়াক দিয়ে দাত মাজা। এতে সুন্নত ও আদায় হবে পাশাপাশি দাত পরিস্কার হবে রোজার ও কোন ক্ষতি হবে না। 

প্রশ্নঃ তারাবি না পড়লে কি রোজা হবে? 

উত্তরঃ তারাবির সাথে রোজার কোন সম্পর্ক নেই। তারাবি আর রোজা আলাদা বিষয়। তারাবি না পড়লেও রোজা হয়ে যাবে। তবে যেহেতু তারাবি সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ তাই কোন কারণ ছাড়া তারাবি না পড়লে গোনাহগার হবে। 

রোজা বা তারাবি সম্পর্কে কারোর কোন প্রশ্ন থাকলে কমেন্ট বক্সে আপনার প্রশ্নটি যুক্ত করুন। আমরা যথাযথ   প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করবো। 

রোজা সম্পর্কে এই ভিডিও গুলো দেখতে পারেন



শেষ কথা 

রোজা আল্লাহ তায়ালার ফরজ ইবাদত। এর পুরস্কার আল্লাহ নিজ হাতে বান্দাদের দিবেন। তাই এই রোজা আমাদের যথাযথ ভাবে পালন করা উচিৎ। রোজা ভঙ্গের কারণ ও রোজার মাকরূহ কাজ সমূহ থেকে আমাদের বেঁচে থাকতে হবে। এবং রমজানে বেশি বেশি আল্লাহর ইবাদত করতে হবে। 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url